Description
স্বাধীনতা-প্রাপ্তির ৭২ বছর পরেও একজন ভারতবাসীও জানেন না। তিনি ভারতের নাগরিক কিনা। পৃথিবীর আর কোন দেশে দীর্ঘ ৭২ বছর ধরে নাগরিকত্ব দেওয়া নিয়ে দেশের মানুষকে এভাবে বঞ্চনা করা হয়েছে কিনা, আমাদের জানা নেই। কিন্তু আজ যখন দেশের মানুষকে নাগরিকত্বের মান্যতা দেওয়ার জন্য এবং প্রতিবেশী মুসলমান রাষ্ট্রগুলির নিপীড়িত সংখ্যালঘুদের নাগরিক হিসেবে মর্যাদা দেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার নড়েচড়ে বসেছে, যখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে আইনী পদ্ধতিতেই যে, অন্যান্য দেশের মতই ভারতবর্ষেও বিদেশী অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করতে হবে নাগরিক পঞ্জিকরণ, তখন সব বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি। একযোগে রে রে করে উঠেছেন। গোটা দেশ জুড়ে জ্বলছে আগুন। চলেছে ভাঙচুর। নাগরিকত্ব আইন কি? নাগরিক পঞ্জিকরণ কেন প্রয়োজন? গোটা দেশসহ পশ্চিমবঙ্গের জনবিন্যাস তত্ত্বের হাল-হকিকৎ নিয়েই এই সংকলন –‘প্রসঙ্গ দেশভাগ ও ভারতীয় নাগরিকত্ব।
দেশভাগ এবং ভারতবর্ষের স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর থেকেই যে সমস্ত আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতি সমস্যায় দেশ ও জাতি জর্জরিত হয়ে রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হল এদেশের উদ্বাস্তু সমস্যা। উত্তর ভারতে এই সমস্যা যতটা প্রকট তার চেয়ে অনেক বেশি প্রকট উত্তর-পূর্ব এবং পূর্ব ভারতে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে। উত্তর ভারতের পাঞ্জাব এবং রাজস্থানে সরাসরি সরকারি হস্তক্ষেপে সমস্যা অনেকটা শিথিল হলেও, পশ্চিমবঙ্গের সমস্যা দীর্ঘ থেকে প্রতিনিয়ত দীর্ঘতর হয়েছে স্বাধীনতা প্রাপ্তির অব্যবহিত পর থেকেই। এর কারণ, পশ্চিমবঙ্গের পাশেই অবস্থান বর্তমানে স্বাধীন ইসলামিক রাষ্ট্র বাংলাদেশ যা ১৯৭১ এর আগে পর্যন্ত ছিল পাকিস্তানের অন্যতম অঙ্গ। বাংলাদেশ ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার পর সমস্যা আরও ভয়াবহ হয়েছে দুটি কারণে। প্রথমটি অবশ্যই কাঁটাতার বিহীন পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ সীমান্ত অঞ্চল। তার চেয়েও ভয়াবহ হল বাংলাদেশের থেকে ১৯৭১ সালের পর থেকেই অবিরাম অনুপ্রবেশকারীদের ভারতে আগমন। এই অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে একটা অংশ হিন্দু বা বৌদ্ধ যাঁরা দেশবিভাজনের সময় পূর্ব পাকিস্তানেই থেকে গিয়েছিলেন। সেই পূর্বতন পূর্ব-পাকিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশে পরিণত হবার পর যেদিন ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ধর্মের মর্যাদা দিল সেদিন থেকেই মূলত হিন্দু এবং বৌদ্ধদের ওপর নানা রকমের দৈহিক, সম্পত্তিগত ও ধর্মীয় অত্যাচার সহ্যের সীমা অতিক্রম করল। তাঁরা বাধ্য হলেন বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতবর্ষে উদ্বাস্তু হয়ে আশ্রয় নিতে। মানবিকতার খাতিরে এসবই মেনে নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু সমস্যা দেখা দিল যখন হিন্দুদের পায়ে পা মিলিয়ে পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ মদতে মুসলমানরাও সীমান্ত অতিক্রম করে পশ্চিমবঙ্গে ভিড় জমাতে শুরু করল। এদের ওপর কোন ধরনের অত্যাচারই হয়নি বাংলাদেশে কারণ বাংলাদেশের যা রাষ্ট্রীয় ধর্ম, ওই জনসমষ্টির ধর্মও তাই। কিন্তু এই অনুপ্রবেশ ছিল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এদের প্রত্যেকেরই জমি-জমা, ঘর-বাড়ি অটুট রয়েছে বাংলাদেশে। আবার তাঁরা পশ্চিমবঙ্গে এসেও ঘরবাড়ি ফেঁদে এদেশে নতুন সংসার পেতেছেন। অর্থাৎ গাছেরও খাব, তলারও খাব মনোভাব। আর দীর্ঘদিন ধরে রাজ্যের শাসকদল ও সরকার (১৯৭১ থেকে যে দল যখন শাসক ছিল) এই সমস্ত উদ্বাস্তু ও অনুপ্রবেশকারীদের ব্যবহার করে এসেছে ভোট ব্যাঙ্ক হিসেবে।
হিন্দু মহাসভা তথা জনসংঘ নেতা ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ঐকান্তিক চেষ্টায় জনবিন্যাসের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য যে পূর্ব-পাকিস্তান ও পশ্চিমবঙ্গ হিসেবে বিভাজিত হয়েছিল অখণ্ড বাংলা, সেই জনবিন্যাস এই সব কারণে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হিসেব করে দেখা গেছে অনুপ্রবেশের কারণে রাজ্যের মুসলমান
জনসংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে প্রতিবছরে। সেই সঙ্গে বেড়েছে মোখলি সংস্কৃতির আগ্রাসন। গত দশ বছরে সেই আগ্রাসন শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রহরের কারণেই সমস্ত সীমা অতিক্রম করে গেছে।
উত্তর ভারতে বা দক্ষিণ ভারতে নেহরু-লিয়াকত চুক্তি কার্যকর করে মুসলমানরা থাকবেন পাকিস্তানে, হিন্দুরা থাকবেন ভারতবর্ষে—এই ব্যবস্থা সফল হলেও, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি। ফলত পশ্চিমবঙ্গকে করিডোর হিসেবে ব্যবহার করে অনুপ্রবেশকারী পাক-পন্থী মুসলমানরা ছড়িয়ে পড়েছে গোটা ভারতবর্ষেই।। আর ওই সব ভারত বিদ্বেষী জনসমষ্টির প্রভাবে প্রভাবিত হচ্ছেন ভারতীয় মুসলমান সমাজেরও একাংশ কারণ ওই জনসমাজ গত ৭০ বছরেও ধর্মীয় সংকীর্ণতার বেড়া ভেঙে শিক্ষিত, সংস্কৃত আদি এবং অকৃত্রিম ভারতীয় সমাজের শরিক হয়ে উঠতে পারেনি। কিছুটা তাঁদের মানসিকতার জন্য। আর অনেকটাই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ন্যক্কারজনক সংখ্যালঘু তোষণের রাজনীতির জন্য।
এই পরিস্থিতিতে দেশের কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদীর নেতৃত্বে ৪১ শতাংশ ভারতবাসীর সমর্থনে ভারতীয় জনতা পার্টি ক্ষমতায় আসার পর নাগরিকত্ব সংশোধন ও নাগরিক পঞ্জিকরণের কাজ শুরু করার প্রতিশ্রুতি দেয়। কারণ জনবিন্যাসের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাওয়ায় গোটা দেশের অর্থনীতিই আজ বিপন্ন। সংস্কৃতি বিপন্ন। পাকিস্তানের মদতে ভারতবর্ষ আজ বিশ্বের জেহাদি সন্ত্রাসবাদের সামনে সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক পরিস্থিতির মুখোমুখি।
কিন্তু ভারতবাসীর দুর্ভাগ্য, বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলি শুধুমাত্র ভোটব্যাঙ্কে আঘাত পড়বে বুঝেই চরম বিরোধিতায় নেমেছে। সমানে চলছে মিথ্যা প্রচার। অন্য রাজ্যগুলির চাইতে এই মিথ্যা প্রচারে কয়েক হাজার গুণ বেশি পশ্চিমবঙ্গে।
দেশভাগ কেন হল। নাগরিকত্ব আইন কি ও কেন? সংশোধনী প্রস্তাবের মূল বিষয়গুলি কি কি? নাগরিক পঞ্জিকরণ কেন প্রয়োজন?—এই সমস্ত বিষয়গুলি নিয়েই তাই প্রকাশিত হল এই সংকলন। আশা করি, এই সংকলন জনগণের বিভ্রান্তি দূর করবে এবং মিথ্যা প্রচারের স্বরূপ চিনিয়ে দেবে ভারতবর্ষকে। যে সমস্ত লেখক তাঁদের লেখা দিয়ে এই সংকলনকে সমৃদ্ধ করেছেন, তাঁদের সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও অভিনন্দন।
Reviews
There are no reviews yet.